'সিহর' (যাদু), 'আইন' (নজর) ও 'হাসাদ' (হিংসা) বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বহু সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে, বহু মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করছে, এমনকি অনেকে দুনিয়ার মুখ দেখার আগেই বিদায় নিচ্ছে এই অপরাধের শিকার হয়ে।
এ ধরনের অপরাধীদের চেনার আলামত হিসেবে তাদের কতিপয় মতিগতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:-
(ক) খাবারকেন্দ্রিক আচরণ ও তৎপরতা:
১। কারো খাবারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এটা করতে গিয়ে কোন কোন সময় চোখের কালার পরিবর্তিত হওয়া; বিশেষ করে লাল, গোলাপী বা নীল বর্ণ ধারণ করা। [তবে কোন কোন সময় ভিকটিমেরও চোখের রঙ পাল্টাতে পারে জিন ভর করার কারণে।]
২। যৌক্তিক ও জরুরী কারণ ছাড়া নানান বাহানায় খাবার আলাদা করার ধান্ধায় থাকা। অর্থাৎ, নিজেদের জন্য একধরনের খাবার এবং যাদের অনিষ্ট করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য আরেক ধরনের খাবারের অর্ডার প্রদান করা। নিজেদের খাবারের রুচির ব্যাপারে মিথ্যা অযুহাত দিয়ে হলেও দুই পক্ষের জন্য পৃথক আইটেমের আবদার করা।
এই খাবার আলাদা করার কাজটি অনিষ্টকারীরা সরাসরি নিজেদের জন্য আলাদা খাবার তৈরির ফরমায়েশ প্রদানের মাধ্যমেও করাতে পারে, অথবা রান্না নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত ভুল ধরা ও খবরদারি করার দ্বারা খাবারকে ভিকটিমের জন্য অরুচিকর করে তোলার মাধ্যমে ভিকটিমকেই বাধ্য করে, যাতে ভিকটিম নিজেদের জন্য আলাদাভাবে রান্না করে খেতে বাধ্য হয়।
[অবশ্য কোন কোন সময় ভিকটিমও নিজের ইচ্ছায় খাবার আলাদা করে নিতে পারে, যদি সে নিজের জন্য আলাদা খাবারকে সুরক্ষিত করে রাখা ও তা স্পর্শ থেকে অনিষ্টকারীদেরকে বিরত রাখার মতন সক্ষমতা অর্জন করে থাকে।]
৩। (a) কোন জরুরত ছাড়াই নিজেরা ঝট করে আগে খেয়ে নেওয়া এবং তারপর বসে বসে অন্যদের খাওয়া দেখা। [তবে অন্যের যাদু বা বদনজরের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য (অর্থাৎ, কেউ যাতে খাবারে অনিষ্ট করার সময় ও সুযোগ না পায় সেই জন্য) খাবারটা বিশুদ্ধ ও নিরাপদ থাকতে থাকতে ঝট করে আগে খেয়ে নেয়াটা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আর অন্যের খাওয়া দেখা বলতে ১ নং পয়েন্টে বর্ণিত বিশেষ ধরনের দৃষ্টির কথা বুঝিয়েছি।]
(b) কখনো বা ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে নিজেরা সবার শেষে খাওয়া। খাবারের অর্ধাংশ ঝটপট গরম করে বেড়ে দিয়ে অন্যদের জন্য রেখে যাওয়া, যাতে অন্যরা এটা খাওয়া শেষ করার পর নিজেদের জন্য নতুন করে খাবার নামিয়ে গরম করে খাওয়া যায়। কিন্তু নিজেরা আগে খেলে পুরাটাই একবারে নামিয়ে খাবার টেবিলে পরিবেশন করা।
(c) খাবার টেবিলে গরম ও টাটকা খাবার পরিবেশিত অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও (বিশেষ করে নিজে রান্না-বাড়ার সাথে জড়িত না থেকেও) নিজের খাবারটি পাকঘরে পাতিল থেকে নিতে যাওয়া এবং এই সুবাদে পাতিলের খাবারটা চোখ বুলিয়ে ও নেড়েচেড়ে দেয়া। এ কাজটা তখনই করে, যখন নিজেরা আগে খেয়ে নিচ্ছে এবং টার্গেটকৃত ব্যক্তিরা পরে খাবে। [অবশ্য কেউ ভিকটিম হয়ে থাকলে এবং টেবিলে পরিবেশিত খাবারে যাদু করা আছে এমন হয়ে থাকলে সেটা avoid করার স্বার্থে নিরাপদ খাদ্যের সন্ধানে পাকঘরের পাতিলে হানা দেয়া দোষের নয়। এছাড়া সবাইকে ভালোটা খাইয়ে নিজে পাতিলের তলারটা খাওয়ার প্রবণতা থাকলে অথবা তলার ভাত/পোলাও বেশি পছন্দ হয়ে থাকলে সেটাও ব্যতিক্রম বলে গণ্য হবে।]
৪। সর্বদা পুরাতন তরকারি (তা সে এক বেলার পুরাতন হলেও) খেতে অনীহা, প্রতি বেলায় নিজেরা টাটকা খাবারটা খাওয়া। পুরাতন ও অবশিষ্ট খাবারটি সর্বদা অন্যের জন্য রেখে দেয়া, অন্যকে (মানে, ভিকটিমকে) খেতে বাধ্য করা। এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতি বেলায় অতিরিক্ত খাবার নামানো, যাতে উদ্বৃত্ত থেকে যায়, আর পরের বেলায় সেটা প্রতিপক্ষকে খাওয়ানো যায়। অথবা, প্রতিদিন অতিরিক্ত ভর্তা বানানো, যাতে পরের দিন ওটা প্রতিপক্ষকে গেলানো যায়। [অবশ্য বিষয়টা বুঝতে পারার পর ভিকটিমরাও পুরাতন তরকারি avoid করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং কারো মধ্যে পুরাতন খাবার পরিহারের প্রবণতা দেখা গেলেই তাকে অপরাধী ভাবা যাবে না। হতে পারে সে অপরাধী, হতে পারে সে ভিকটিম, অথবা হতে পারে সে এর কোনোটাই নয়।]
৫। কোন নির্দিষ্ট খাবার (বিশেষ করে পুরাতন ও অবশিষ্ট খাবার) অন্যকে খাওয়ানোর জন্য পেরেশান হওয়া। অন্যকে খাওয়াতে না পারলে খাবার নষ্ট হবার জন্য মিথ্যা আবেগ ও মায়াকান্না জুড়ে দেয়া। অথচ এদের মনোকষ্টের কারণ খাবার নষ্ট হওয়া নয়, বরং খাবারের মধ্যে কৃত শয়তানী কাজের পরিশ্রমটা বৃথা যাওয়া।
৬। কোন খাবার নিজেরা খেতে অনীহা প্রকাশ করা, কিন্তু অন্যকে খাওয়াতে উৎসাহী হওয়া। [সরল মানুষ এটাকে মহত্ত্ব ভেবে মুগ্ধ হলেও কোন মহত্ত্ব এখানে কাজ করে না।]
৭। রান্নার চেয়ে বাড়ার কাজে বেশি উৎসাহ। খাবার তৈরির কাজ অন্যকে দিয়ে করাতে অভ্যস্ত হলেও পরিবেশন, সংরক্ষণ ও বণ্টনের কাজ সবসময় নিজেদের হাতে সম্পন্ন করা। [এটা নিছক বৈষম্য করা বা কৃতিত্ব নেবার উদ্দেশ্যেও হতে পারে, আবার নাশকতার উদ্দেশ্যেও হতে পারে। অবশ্য কেউ বাড়ার কাজে একটু বেশি দক্ষ হবার কারণে বা শখের বশে উৎসাহী হয়ে থাকলে ভিন্ন কথা।]
বিশেষ করে খাবার বেড়ে দেবার সময় বাছাই করা বা ভাগ করার ছলে দীর্ঘক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তরকারির বাটির দিকে তাকিয়ে থাকা। [টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে (সাধারণত পরিবারের কর্তাকে) পছন্দের খাবারটি (যেমন- মাছের বালিশ) বাছাই করে দেবার অযুহাতে তরকারির বাটির ভিতর চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া ও কাটাছেঁড়ার ছলে এ কাজটি করা হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে পুরো বাটির পরিবর্তে নির্বাচিত খাদ্যাংশটুকুর উপরে যাদু করা হয়।]
৮। অপ্রয়োজনে বার বার ফ্রিজ খোলা; প্রয়োজন ছাড়াই খাবারের পাত্র বারবার উন্মুক্ত করা, নেড়েচেড়ে দেখা; কাজ ছাড়াই পাকঘরে বা খাবার টেবিলে দীর্ঘ সময় অবস্থান বা ঘোরাঘুরি করা। [শুচিবাই বা মানসিক রোগের বশে হয়ে থাকলে ভিন্ন কথা।]
৯। খাবার তৈরি বা সংরক্ষণে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা। বিশেষ করে ভর্তা বানানো, বেলের শরবত বানানো, ফল কাটা, ডিমের খোসা ছাড়ানো, আটা মাখা ও রুটি তৈরিতে অস্বাভাবিক সময় নেয়া। এসব কাজের সময় অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়া (অর্থাৎ, চোখ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ভর্তা বা আটার প্রতি গভীর মনোনিবেশ করা)। হয়তো একটা রুটিই অনেক সময় ধরে বেলা। আম ঝুড়িতে গুছিয়ে রাখার সময় একেকটা আমই অযথা (অর্থাৎ, খুঁত চেকের প্রয়োজন ছাড়াই) বারবার নেড়েচেড়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখা। [শারীরিক অক্ষমতা, মানসিক রোগ বা শুচিবাই হলে ভিন্ন কথা।]
# সর্বোপরি, এরা ভুলেও কখনো একই খাবার সবাই মিলে একই সাথে খেতে রাজি হবে না, এদেরকে কভু ঘাড় ধরেও সবার সাথে একই খাবার খাওয়াতে পারবেন না। এরা হয় দুই পক্ষের জন্য পৃথক খাবারের বন্দোবস্ত করাবে, অথবা একই খাবার হলে পুরো খাবারটা একবারে পরিবেশন করতে না দিয়ে আসন খালি থাকা সত্ত্বেও দুই ছরকটে দুই ধাপে পরিবেশন করবে। নিজেরা হয় তাড়াহুড়ো করে আগে খেয়ে নেবে, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে ঢিলেমি করে সবার শেষে খাবে। আরো লক্ষণীয় যে, যখন নিজেরা আগে খাবে, তখন পুরো খাবারটি ফ্রিজ থেকে নামিয়ে গরম করে টেবিলে পরিবেশন করলেও যখন নিজেরা পরে খাবে, তখন অন্যদেরকে আগে খেতে দেবার সময় পুরো খাবারটি না নামিয়ে অর্ধেক খাবার নামাবে। আর যখন খাবার আইটেম বা সময় কোনটাই আলাদা না করে একসাথে সবার সাথে খেতে বসবে, তখন অন্যের খাবারের প্লেটে নজর প্রদান করবে।
এককথায়, এরা হয় খাবারের আইটেম আলাদা করবে, অথবা সময় আলাদা করবে, অথবা খাবারের টেবিলে বসেই অন্যের খাবারে চোখ দেবে। একেক দিন তারা একেক ধরনের আচরণ করবে। এই তিনটা আচরণের একটাও করছে না, এমন দিন কখনো পাবেন না।
(খ) হিংসা প্রকাশ ও কূটনৈতিক তৎপরতা:
১০। চোগলখুরী ও কুটনামি করা। যৌক্তিক কারণ ছাড়াই মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা। [এটা যাদু নয়, কিন্তু এ কাজে লিপ্ত ব্যক্তিরা যাদুতে জড়িত হয়ে থাকে।]
১১। একই রক্তসম্পর্কের মানুষদের মধ্যে কারো প্রতি বেশি কৃপণ ও কারো প্রতি বেশি বেহিসাব হওয়া।
১২। স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা, দরজা বন্ধ করা, বাচ্চার দুধ খাওয়া ইত্যাদি নিয়ে অহেতুক হিংসা ও অন্তর্জ্বালা প্রকাশ করা। [অবশ্য বাস্তবেই কারো মধ্যে অতিরিক্ত কিছু থেকে থাকলে তা দেখে বিরক্ত হওয়াটা এর অন্তর্ভুক্ত নয়।]
(গ) অন্যান্য অস্বাভাবিক আচরণ:
১৩। সবসময় দিনে ঘুমানো ও রাত্রিজাগরণ করা। [এটিও যাদু নয়, তবে যাদুর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা রাত জেগে মানুষের ঘুম নষ্ট করার কাজে লিপ্ত থাকার প্রয়োজনে সবসময় দিনে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলে। অবশ্য কোন কোন মানুষের নিছক শারীরিক অবস্থা, অভ্যাস বা কোন সাধারণ কাজের নেশার বশেও রাত জাগা ও দিনে ঘুমানো হয়ে থাকে, তারা এর ব্যতিক্রম।]
১৪। নামাজের স্থান হিসেবে টুল বা চেয়ারকে ও টয়লেটের স্থান হিসেবে কমোডকে পছন্দ (Prefer) করা; এবং সেথায় দীর্ঘ সময় বসে থাকা। [সত্যিকার পঙ্গু, বৃদ্ধ বা অক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।]
১৫। ধ্যানের স্টাইলে নামাযের আসনে বসা। চেয়ারে বা টুলে নামাজের সুরতে বসে (মহিলা হয়েও) হাত বুকে বা পেটে কোথাও বাঁধার পরিবর্তে কোনমতে দুই হাত একত্র করে দুই উরুর মাঝখানে রেখে দিয়ে রিল্যাক্স মুডে বসা।
(ঘ) অতিরিক্ত কৌতুহল ও নজরদারি:
১৬। মানুষের শারীরিক অবস্থা নিয়ে অতিরিক্ত কৌতুহল প্রকাশ করা। বিশেষত কারো শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখে এবং বিশেষ কোন উপসর্গ (যেমন- চেহারা বা ত্বকের সমস্যা) কাটিয়ে উঠতে দেখে উদ্বেগ ও অসন্তোষ মিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ ও রহস্য অনুসন্ধান করা। মানুষের সুস্থতা অর্জনের পিছনে ঝাড়ফুঁক ও তন্ত্র-মন্ত্রের সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করা।
বিশেষ করে যদি দেখেন, আপনার চেহারা আসলে আগের চেয়ে সুশ্রী হয়নি, বরং কুশ্রী হয়েছে; তারপরও কেউ আপনার চেহারা 'ভালো' হবার রহস্য নিয়ে কৌতুহল ও বিস্ময় প্রকাশ করছে; তাহলে বুঝতে হবে, আপনার চেহারা আরো খারাপ বানানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় খারাপ বানাতে না পেরে পেরেশান হয়ে পড়েছে। যদি কারো চেহারা দু'এক বছর আগের তুলনায় উন্নতি হয়, তাহলে সেটা দেখে বিস্মিত হওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব। কিন্তু যার চেহারা ২/৪ বছর আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে, কিন্তু হয়তো দু'এক ঘন্টা বা দু'এক বেলার তুলনায় একটু ভালো হয়েছে, তাকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করা কেবল তাদের দ্বারাই সম্ভব, যারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চেহারার উপর খারাপ কিছু করার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত আছে এবং উন্নতি-অবনতি ২৪ ঘন্টা ফলো করছে।
[ব্যতিক্রম: যাদুকর ডাইনীরা নিজেরা অন্য মানুষের শারীরিক সুস্থতা চুরি করে নিজেরা সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য লাভ করে থাকে। তাই কারো এরূপ অন্যায় ও অবৈধ পন্থায় অস্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্য ও যৌবন লাভ করতে দেখে তার স্বাস্থ্যের রহস্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা এর অন্তর্ভুক্ত নয়।]
১৭। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা কর্ম নিয়ে অতিরিক্ত নাকগলানো ও খবরদারি করা। মানুষ কখন কী করছে, কেন করছে, কী দোয়া পড়ছে, গায়ে কী তেল মাখছে— ইত্যাদি খুঁটিনাটি সকল বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো। পারলে ২৪ ঘন্টা একটা মানুষকে বা পরিবারকে observe ও follow করা। এই তদারকি ও নজরদারির কাজটা যাদুকরররা নিজেরাও করতে পারে, অথবা নিজেদের অকালপক্ক বাচ্চা-কাচ্চাদের দ্বারাও করাতে পারে।
১৮। মানুষের লোকেশন ও শিডিউল জানার জন্য অনাবশ্যক পীড়াপীড়ি।
১৯। কে কবে বাচ্চা নেবে কি না নেবে, কার বাচ্চা হলো কি না হলো, হবে কি না হবে— এ নিয়ে অপ্রয়োজনে ঘাটাঘাটি করা। কারো প্রেগনেন্সির সংবাদ পেলে এখন কত মাস, ডেলিভারির ডেট কবে, কোন্ ডাক্তার দিয়ে করা হবে, কোন্ হাসপাতালে হবে— ইত্যাদি তথ্য লাভের জন্য অতিরিক্ত পীড়াপীড়ি করা বা করানো।
২০। সবকিছু সবার সাথে (মূলত: তাদের সাথে) শেয়ার করতে হবে; নিজেদের সব সমস্যা ও ভালো-মন্দ সবাইকে (মূলত: তাদেরকে) জানাতে হবে— এই মর্মে জোরালো আবদার করা বা করানো। [অবশ্য কেউ যদি এমন হয়ে থাকে যে, নিজ বুদ্ধিতে কারো সাথে পরামর্শ না করে কাজ করার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন তার ভালোর জন্য কেউ এমন আবদার করে থাকলে সেটা ব্যতিক্রম বলে গণ্য হবে।]
# নজরদারি ও খবরদারির উদ্দেশ্য:
প্রথমত, কারো উপর যাদু করতে হলে তার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানার দরকার হয়। সে কোথায় কি অবস্থায় আছে, সেটা সঠিকভাবে জানতে পারলে টার্গেট করা সহজ হয়।
যেমন- শারীরিক অবস্থা জানতে পারলে অসুস্থতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, লোকেশন জানতে পারলে জিন চালান করা (সম্ভব হলে দুর্ঘটনা ঘটানো) সহজ হয়, গর্ভাবস্থা বা ডেলিভারির সময় জানতে পারলে সময় মতো নাশকতা ও অনিষ্ট সম্পন্ন করা যায়।
দ্বিতীয়ত, যাদুকরের যাদুর সফলতা ও কার্যকারিতা যাচাই করা। মিশন কতটুকু সফল হলো বা ব্যর্থ হলো, ভিকটিমের ক্ষয়ক্ষতি কি মাত্রায় হলো, টার্গেট পূরণে আরো কতটুকু কি করার দরকার আছে, সেটা নির্ণয় করা।
তৃতীয়ত, (যাদুকরের) ব্যর্থতা বা (ভিকটিমের) প্রতিরোধের কারণ উদঘাটন করা। যাদুকর ডাইনীর যাদুকার্য বা অনিষ্টক্রিয়া কেন বাধা পাচ্ছে বা ব্যর্থ হচ্ছে, ভিকটিমের কোন্ আমলের কারণে তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা।
চতুর্থত, সম্ভব হলে ভিকটিমের আমলকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে ভিকটিমকেই যাদুকর সাব্যস্ত করা, অথবা যাদুর অপবাদের জবাবে ভিকটিম সঠিক তথ্য প্রকাশ করলে সন্দেহ ও অবিশ্বাস প্রকাশের অভিযোগে গায়ের জোরে ভিকটিমকে ঘরছাড়া করানো।
[ব্যতিক্রম: যাদুর ভিকটিমরা নিজেরা আমল করার জন্য বা প্রতিকার লাভের জন্য পরস্পর খোঁজ-খবর নেয়া ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা এর অন্তর্ভুক্ত নয়।]
(ঙ) পরস্পরবিরোধী আচরণ:
২১। একই ব্যক্তির সাথে একসময় অস্বাভাবিক কৃপণতা এবং আরেক সময় অস্বাভাবিক উদারতা দেখানো। যেমন- একসময় বাচ্চার দুধের ঢোক আর আদার ফোঁটার হিসাব নেয়া, নানান বাহানায় বাচ্চাকে আর বাচ্চার মাকে সবরকম খাদ্য ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত রাখতে সদাতৎপর থাকা; আবার আরেক সময় সেধে সেধে উপাদেয় খাবার খাওয়ানো, লক্ষ টাকার সোনার গয়না দিতেও বাধা না দেয়া। একসময় বউকে দিয়ে সবার রুচিমত সব খাবার প্রস্তুত করিয়েও বউয়ের পছন্দমতো কিছু রান্নার অনুমতি না দেয়া, বউকে কিছু খেতে না দেয়া; আবার আরেক সময় নিজেই আগ বাড়িয়ে বউয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানো। একসময় কারো খাওয়ার খোঁটা দিয়ে বাড়ি মাথায় তোলা, আবার আরেক সময় সেই একই ব্যক্তিকে খাওয়াতে না পেরে সিন ক্রিয়েট করা।
২২। প্রয়োজনীয় (required) কাজ pending রেখে অনাবশ্যক কাজ অতিরিক্ত আগ্রহ সরকারে যেচে আগ বাড়িয়ে সম্পাদনের প্রবণতা। সংসারের কমন কাজগুলোতে (যেমন- তরকারি ধোয়া, কোটা ও রান্না) খুব একটা গরজ দেখাবে না, নিজের কাজটাও (যেমন- নিজের প্লেটটি ধোয়া) অন্যের জন্য ফেলে রাখবে, কিন্তু অন্যের কাজ (যেমন- অন্যের জন্য স্পেশাল খাবার তৈরি করে দেয়া, অন্যের বাচ্চার খিচুড়িটি গরম করে দেয়া ইত্যাদি) না চাইতেই এমনকি নিষেধ করা সত্ত্বেও স্বত:স্ফূর্তভাবে করে দেবে।
(চ) রাখঢাক ও গোপনীয়তা:
২৩। (ঘরে কোন পুরুষ মানুষ না থাকা সত্ত্বেও) ইয়া বড় ঘোমটা দিয়ে প্রবেশ করা; নিঃশব্দে প্রবেশ ও বিচরণ করা; তাড়াতাড়ি কাজ সেরে দ্রুত কেটে পড়া। [ব্যতিক্রম: অপরাধীকে ধরা বা অপরাধীর অপরাধের আলামত সংগ্রহের জন্য গোপন তৎপরতা ও তল্লাশি অভিযান এর অন্তর্ভুক্ত নয়।]
২৪। অতিরিক্ত পর্দার ছলে নিজেকে দৃষ্টির আড়ালে রাখার প্রবণতা। [ব্যতিক্রম: সত্যিকার ধার্মিকদের ক্ষেত্রে এটা কোনো মন্দ আলামত নয়।]
২৫। আপনার উপস্থিতিতে আপনার বাচ্চাদের যতটা সার্ভিস দেবে, আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার বাচ্চাদের খেদমত করার কাজে তার চেয়ে বেশি উৎসাহী হবে। যেমন- আপনার মেয়ের চুলের বেণী করে দেয়া বা উঁকুন বেছে দেয়া (চুল সংগ্রহ করাই এর সম্ভাব্য লক্ষ্য), আপনার শিশুর খাবারটি গরম করে দেয়া ইত্যাদি। [ব্যতিক্রম: সত্যিকার দরদী বিশ্বস্ত অভিভাবকের ক্ষেত্রে কিংবা রিয়াকারিতা থেকে বাঁচতে সচেষ্ট নিষ্ঠাবান সেবকের ক্ষেত্রে এমনটি কোনো নেতিবাচক লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে না।]
এই হীন স্বভাবটা একদিনে গড়ে ওঠে না। কোন মানুষ হঠাৎ করে রাতারাতি যাদুকর হয়ে যায় না। শৈশব থেকেই এ চরিত্রটা বিকশিত হতে থাকে। যারা বৈষয়িক মানসিকতা নিয়ে বড় হয়; যাদের মন সবসময় অন্যের খাওয়া-পরা, বাড়ি-গাড়ি ও টাকা-পয়সার দিকে পড়ে থাকে; টাকায় অস্বচ্ছল হলে হীনমন্যতায় ভোগে আর স্বচ্ছল হলে অহংকারে ফেটে পড়ে; এককথায় লোভ ও পরশ্রীকাতরতা মনের মধ্যে বয়ে বেড়ায়; তারাই বয়ো:প্রাপ্তির পর উপযুক্ত সুযোগ ও জায়গা পেলে গুপ্তবিদ্যার দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর একেকটা যাদুকর ডাইনীতে পরিণত হয়।
এরা হলো সমাজের ভদ্রবেশী মুখোশধারী শয়তান। তীক্ষ্ণবুদ্ধির কূটকৌশলে পরিপক্ক ও শয়তানী কাজে ত্বরিৎকর্মা হলেও সমাজের চোখে এরা ফেরেশতার মতন সাধাসিধে। আল্লাহ নিজ গুণে এদের মুখোশ উন্মোচন না করলে এরা চিরদিন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। এমনকি উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়েও পার পেয়ে যাবে।
বি:দ্র: (১) বর্ণিত লক্ষণগুলোর মধ্যে দু'-চারটি আচরণ কারো সাথে মিলে গেলেই তাকে সন্দেহ করা যাবে না। 'ক', 'খ' ও 'গ' এই তিনটি অংশের প্রত্যেকটি অংশ থেকে কমপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ করে লক্ষণ মিলতে হবে। আর নিয়মিতভাবে এসব আচরণ ও কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিনা, দেখতে হবে।
(২) কারো দৃষ্টি দেখেই তাকে যাদুকর বা বদনজরকারী ভাবা যাবে না। তার দৃষ্টির দ্বারা কারো শারীরিক-মানসিক ক্ষতি বা অস্বস্তির উদ্রেক ঘটেছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে হবে।
(৩) অনেক সময় মূল যাদুকর অন্য কাউকে সম্মোহন করে বা কারো মধ্যে যাদুর এনার্জি সঞ্চারিত করে তাকে দিয়েও ভিকটিমকে স্পর্শ বা নজর প্রদান করাতে পারে। সেরকম ক্ষেত্রে মূল যাদুকর পর্দার আড়ালেই থেকে যায় এবং মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত ব্যক্তির আচরণে বর্ণিত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। এভাবে সম্মোহিত বা বশীভূত হয়ে যাদুর এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত ব্যক্তির পরে আর এসব কথা মনে থাকে না।
(৪) কেউ যদি সত্যিকারভাবেও যাদুকর প্রমাণিত হয়, তাকে আপনারা সরাসরি শাস্তি দিতে পারবেন না; বরং যা করার দোয়ার মাধ্যমেই করতে হবে। আর বলাবাহুল্য, দোয়া ও প্রার্থনার দ্বারা শুধু প্রকৃত অপরাধীই শায়েস্তা হবে। সুতরাং এই লেখাটির দ্বারা নিরপরাধ মানুষ হয়রানি হবার তেমন কোন আশঙ্কা নেই।
(৫) যদি সবগুলো লক্ষণও কারো সাথে মিলে যায়, আর তার দ্বারা যদি আপনাদের কারো শারীরিক-মানসিক বা দাম্পত্য সমস্যা ও ভোগান্তিও ঘটতে থাকে, তাহলে কি করবেন? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে ঝগড়া ও মারামারি শুরু করবেন? না। এমনটি করলে আপনাকেই হাসির পাত্র হতে হবে, পাগল প্রমাণিত হতে হবে। বরং ধৈর্য্যের সাথে ঠাণ্ডা মাথায় আল্লাহর উপর ভরসা করে রুকিয়া শুরু করে দিন। আশা করা যায়, আল্লাহর রহমতে আপনি সুস্থ হতে থাকবেন, আর আপনার সমস্যা ও দুরবস্থাগুলো যাদুকর ব্যক্তির দিকে divert হতে থাকবে। রুকিয়ার দ্বারা সুফল লাভ ও অপরাধীর শাস্তির জন্য এমনকি যাদুকর ডাইনীকে চেনাটাও জরুরী নয়। এমনও দেখা গেছে, একটা মেয়ে তার উপর ঘটিত প্যারানরমাল উপদ্রবকে নিছক লাভার জিনের কাজ মনে করে রুকিয়া শুরু করেছে, আর ওদিকে তার শাশুড়ী অসুস্থ হয়ে পড়েছে, যার জন্য তাকে রুকিয়া বন্ধ করে গ্রামের বাড়ি ছুটে যেতে হয়েছে।
(৬) অনেক সময় যাদুটোনা ও নাশকতাকারীদের কর্মকাণ্ড ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, তাদের অনিষ্ট মোকাবেলা এবং তাদের কবল থেকে ভিকটিমদের রক্ষার জন্যও কেউ পাকঘরে যাতায়াত করতে পারে, খাবার টেবিলের সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, রাত জেগে ঘরে পায়চারি করে পাহারা দিতে পারে। সুতরাং কে অনিষ্টকারী (মুফসিদূন), আর কে হিতাকাঙ্ক্ষী (মুসলিহূন), তা ভালো করে নিশ্চিত হতে হবে। কে দংশনকারী সাপ, আর কে দংশিত ক্ষতস্থানে গাছ দিতে আসা বা আগ্রাসী সাপকে মারতে আসা বেজি, সেটার পার্থক্য করা শিখতে হবে।
(৭) মানুষের খাবার রুচিতে পার্থক্য থাকতেই পারে। পুরাতন ও বাসি খাবার খেতে অনীহা থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের থেকে দুর্বৃত্তদেরকে আলাদা করার উপায় হলো, এই যাদুকর ডাইনীরা খাবার আলাদা করার ধান্ধাবশত: ইচ্ছাকৃতভাবে রুচির ভিন্নতা দাবি করে থাকে। এদেরকে দেখা যাবে, যেই ধরনের রান্নাকে নিজেদের পছন্দ দাবি করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তাদের পছন্দ তা থেকে ভিন্ন। যেমন- নিজেদের জন্য আলাদাভাবে ঝাল ছাড়া তরকারি রান্না করালেও তারা চুরি করে বা প্রকাশ্যে ঝালওয়ালা তরকারি থেকেও খেয়ে থাকে।
একই ব্যাপার ঘটে পুরাতন খাবার পরিহারের ক্ষেত্রেও। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ অভ্যাসটি থাকলে সেটা সাধারণত সর্বদা একই নিয়মে হয়ে থাকে। কিন্তু যাদুকর ডাইনীদের ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে মিথ্যা অযুহাত মাত্র। দেখা যাবে, তারা একসময় তিন দিন আগের পুরাতন তরকারিও খেতে পারছে, আরেক সময় দুপুরের তরকারি রাতে না খেয়ে অন্যকে খেতে বাধ্য করছে। নিজেদের বাচ্চাদের খাবার অতিরিক্ত রয়ে গেলে সেটা ফেলে দেয়, কিন্তু অন্যের বাচ্চার খাবার ফ্রিজে রেখে দিয়ে পরে খেয়ে ফেলার উপদেশ দেয়। আর মুরুব্বীর কথা সরল বিশ্বাসে মেনে নিয়ে সেটা খেয়ে যথারীতি বাচ্চার মায়ের পেটে সমস্যাও ঘটে থাকে।
# সর্বোপরি বলি, বর্ণিত সবগুলো লক্ষণ কারো আচরণে দেখা গেলেও তাকে সন্দেহ করবেন না; যতক্ষণ পর্যন্ত তার সংশ্লিষ্ট চাহনি বা আচরণের প্রভাবে কিংবা তার হাত ও চোখ লাগানো খাবারের প্রভাবে আপনাদের কারো কোন শারীরিক, মানসিক বা দাম্পত্য সমস্যা না ঘটে। এছাড়া কোন সমস্যা ঘটে থাকলেও ওসবের সাথে সমস্যাটির কার্যকারণ সম্বন্ধ সূক্ষ্ম ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিতে হবে।